সব খবর সবার আগে
বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

মতামত

সৌদি আরব পেরেছে বাংলাদেশ পারবে না?

0 182

আধুনিক বিশ্বের বিজ্ঞানসম্মত কসাইখানা পাবলিক হেলথ মেডিকেল সায়েন্স ও এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু দেশের শহরগুলো অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠায় কোরবানির মতো ধর্মীয় অনুশাসনও জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষা করে পালন করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে নগরে বিজ্ঞানসম্মত অবকাঠামো, রাস্তা, মাঠ, পার্ক, পার্কিং এরিয়া; ড্রেনেজ-স্যুয়ারেজ-ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম গড়ে ওঠেনি, সেখানে কোরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সত্যিই কঠিন।

দেশে গড়ে ঈদুল আজায় প্রতিবছর যেসব পশু কোরবানি হয়, এর অধিকাংশ হয় শহরাঞ্চলে। কয়েক বছর ধরে বর্জ্য অপসারণে সিটি করপোরেশন বা পৌর কর্তৃপক্ষ পলিথিনের ব্যাগ সরবরাহ করছে। ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কঠিন বর্জ্যগুলো অপসারণ করছে। কিন্তু তরল বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি। স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনেজের অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা এবং নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পাশ কাটিয়ে চলার অভ্যাস পরিস্থিতি আরও সঙ্গিন করে তুলছে। ফলে কোরবানির তরল বর্জ্য হয়ে পড়ছে পরিবেশ দূষণের হুমকি। এতে জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

আমি মনে করি, মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে পাইলট প্রকল্প হিসেবে হলেও স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব আধুনিক কসাইখানা তৈরি করতে হবে। সেখানে কোরবানির সময় ছাড়াও সারাবছর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে গবাদি পশু জবাই করার সুযোগ তৈরি হবে। মধ্যপ্রাচের দেশগুলো ইতোমধ্যে উন্নত দেশগুলোর মতো স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব কসাইখানা তৈরি করেছে। সুতরাং আমরা কেন অন্তত নগরগুলোতে আধুনিক কসাইখানা বা স্লটার হাউস প্রতিষ্ঠা করতে পারব না?

পাবলিক স্লটার হাউস ১৮১০ সালে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে সম্রাট নেপোলিয়নের সময় স্থাপিত হয়, যা ১৮৬৮ সালে প্যারিসের কেন্দ্রীয় কসাইখানা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৮৭৪ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম মিট-ইন্সপেক্টর নিয়োগ করা হয় এবং ১৮৭৫ সালে ইংল্যান্ডে কেন্দ্রীয় কসাইখানায় পাবলিক হেলথ অ্যাক্ট জারি করা হয়। ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের রুদ্রাক গ্রামে ৪০০ একর জমির ওপর আধুনিক কসাইখানা গড়ে তোলা হয়েছে। বাবসা প্রতিষ্ঠানটির নাম আল কাবির প্রাইভেট লিমিটেড।

বিশ্বব্যাপী স্লটার হাউসগুলো প্রায় অভিন্ন নীতিমালা মেনে চলে। ১. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা; ২. শিল্প এলাকা বা নগরাঞ্চল থেকে দূরে স্থাপন করা; ৩. প্রশস্ত জায়গা থাকা– বর্তমান আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী বছরে এক লাখ গরু, মহিষ বা পাঁচ লাখ ছাগল-ভেড়া জবাইয়ের জন্য ৫ একর জমি লাগে; ৪. মেঝেতে পরিষ্কার খসখসে টাইলস থাকতে হবে; ৫. প্রচুর আলো-বাতাস, ভেন্টিলেশন, স্বাভাবিক পানি, গরম পানি, পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকতে হবে; ৬. কসাইদের টুপি, জাম্প স্যুট, বুট, জীবাণুমুক্ত গাউন থাকতে হবে; ৭. জবাই বা কাটার ছুরি বা ইলেকট্রিক করাত অবশ্যই জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার থাকতে হবে এবং ছুরি বা যন্ত্রের হাতল কাঠের থাকা চলবে না। হাতল অবশ্যই প্লাস্টিক বা ফাইবারের হতে হবে, যাতে লুক্বায়িত জীবাণু থাকতে না পারে; ৮. সব পশু ও কারখানায় কার্যরত সবাইকে রোগমুক্ত রাখতে হবে, যাতে কোনো ধরনের রোগ দ্বারা পশু বা মানুষ সংক্রমিত না হয়; ৯. কোনো পশু যেন কোনো ধরনের অত্যাচারের শিকার না হয়, পশুকে গাদাগাদি করে, ক্ষুধার্ত বা পিপাসিত রাখা যাবে না; ১০. গর্ভধারিণী বা রোগযুক্ত পশু জবাই করা যাবে না; ১১. জবাইয়ের সময় অবশ্যই পশুর গলার সামনে দিয়ে জবাই করতে হবে, যাতে প্রথমে গলার উইন্ড পাইপ, কারটিড আটারি ও জগুলার ভেইন কাটে, তাহলে শরীর থেকে বেশি রক্ত বেরিয়ে যাবে। রক্তে জীবাণু থাকতে পারে, তাই যত বেশি বের হবে মাংস তত ভালো হবে; ১২. ঘরের কোনো পোশাক বা জুতা পরে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না; ১৩. কসাইখানার ছাদ ৫ মিটার উঁচু হতে হবে; ১৪. স্ট্যান্ডবাই শক্তিশালী জেনারেটর থাকতে হবে; ১৫. বিশাল আকারের পানির রিজার্ভার থাকতে হবে।

স্লটার হাউসকে মূলত কয়েকটি অংশে ভাগ করা যায়। ক. রিসেপ্সন এরিয়া বা ফাইনাল ডাক্তারি পরীক্ষার ছাড়পত্রের জন্য। খ. লিয়ারেজ এরিয়া বা জবাইয়ের আগে পশুদের যেখানে জড়ো করা হয়। গ. স্লটার হলস, যেখানে জবাই করা হয়। ঘ. অ্যাকোমডেশন বা বক্সিং এরিয়া। ঙ. পাকেজিং এরিয়া। চ. রি-ফ্রিজিং বা প্রিডেলিভারি এরিয়া। ছ. ফ্রিজিং ডেলিভারি ভ্যান দিয়ে রিটেল শপ বা কাস্টমারের কাছে পাঠানো।

উন্নত দেশে মোবাইল স্লটার হাউসও রয়েছে। ১৮ চাকাবিশিষ্ট ট্রেইলার ট্র্যাক করে চলমান কসাইখানা আছে, যাতে পশু জবাই করার সব আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ সুবিধাদি, ওয়াক-ইন ফ্রিজার, ৫০০ গ্যালন গরম পানির ব্যবস্থা রয়েছে। সব দেশেই স্লটার হাউসগুলো কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য বিভাগ অনুমোদন দিয়ে থাকে।

বাংলাদেশেও আধুনিক কসাইখানা নির্মাণ সম্ভব। প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। সিটি করপোরেশন থেকে কয়েক বছর ধরে কোরাবানির সময় অস্থায়ী কসাইখানার কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। অথচ নগর ও শহরাঞ্চলে স্থায়ী কসাইখানা সম্ভব, যেখানে সারাবছর পশু জবাই করা যাবে। এতে অনেকের কর্মসংস্থান হবে। বাঁচবে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। জনস্বাস্থ্যও সুরক্ষিত থাকবে।

এ ধরনের কসাইখানার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা একটি বিষয়। কিন্তু সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য মুসলিম দেশ, যেখানে স্লটার হাউসকে বেছে নিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে থাকবে?

লেখক: চিকিৎসক ও গবেষক

সর্বশেষ খবর এবং আপডেটের জন্য আমাদের সাবস্ক্রাইব করুন। আপনি যেকোনো সময় বন্ধ করতে পারবেন।

Loading...

আমরা কুকি ব্যবহার করি যাতে অনলাইনে আপনার বিচরণ স্বচ্ছন্দ হয়। সবগুলো কুকি ব্যবহারের জন্য আপনি সম্মতি দিচ্ছেন কিনা জানান। হ্যাঁ, আমি সম্মতি দিচ্ছি। বিস্তারিত